নিজস্ব প্রতিবেদক, নরসিংদী:
নরসিংদীতে ডিম উৎপাদনকারী পোল্ট্রি খামারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ দূষণের অভিযোগ করছে ভুক্তভোগীরা।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অধিকাংশ খামারী পরিবেশনীতি উপেক্ষা করে লোকালয়ে খামার স্থাপন করায় জনস্বাস্থ্য ব্যাপক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
তারা আরও বলছেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো খামারিদের বিরুদ্ধে নানা অজুহাতে ফার্মের বিরুদ্ধে প্রদক্ষেপ নিচ্ছেন না। এমন কি খামারিদের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের মারধরসহ নানাভাবে অত্যাচারের অভিযোগও করা হয়।
তবে, প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, কেবল বায়োগ্যাস প্লান্ট ব্যবহার করলেই কেবল খামার স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু অতিরিক্ত লাভের আশায় যারা মুরগীর বিষ্ঠা মাছের খাবারের জন্য জমা করে রেখে দেন, তাদের খামার থেকে কেবল দুর্গন্ধ আসে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, খামারীরা বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন করেও এর যথাযথ ব্যবহার না করে অতিরিক্ত লাভের আশায় মাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বিষ্ঠা উৎপাদন করেন।
ফলে, এলাকা গুলোতে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে পরিনেশ নষ্ট করছে এবং খামারের পাশে বসবাসকারীরা জটিল রোগ সহ নানা সমস্যায় ভোগছেন।
নরসিংদীতে জেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের মতে, নরসিংদীতে ডিম উৎপাদনকারী পোল্ট্রি খামার আছে ১৩২০ টি, যেখানে মুরগীর সংখ্যা প্রায় ২১.৬৫ লক্ষ এবং প্রতি বছর ৪৩ কোটি ডিম উৎপাদিত হয়। তারা আরও বলছেন, নরসিংদী জেলার প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে আজ সোমবার পর্যন্ত ২০ টির বেশি খামারের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, এলাকারবাসীর বাঁধা দেয়া সত্ত্বেও ঘনবসতি এলাকায় ২০১৮ সালে নরসিংদী পৌর এলাকার বীরপুরে ডিম উৎপাদনকারী একটি পোল্ট্রি খামার স্থাপন করেন ওই এলাকার আবসার উদ্দিনের ছেলে সালাউদ্দিন ওরফে সেলিম (৪৫)।
পরে, এটির সম্প্রসারণ করে ৩ টি শেডে রুপান্তর করায় হয় এবং বর্তমানে প্রায় আট হাজার মুরগী রয়েছে। ডিমের পাশাপাশি মাছের জন্য বিষ্ঠা জমিয়ে রেখে মাছ উৎপাদনকারী বিভিন্ন খামারে বিক্রি করা হচ্ছে। ফলে, বিষ্ঠা জমিয়ে রাখায় দুর্গন্ধ আরও প্রকট আকার ধারণ করছে এবং এলাকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
এ খামারটির বিরুদ্ধে গত ১২ মার্চ পরিবেশ অধিদপ্তরের নিকট লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
গত ১৯ জুলাই পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অভিযোগ প্রত্যাহার না করায় অভিযোগকারীদেরকে মারধরের অভিযোগ নরসিংদী সদর থানায় লিখিত অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা।
গত সোমবার সরে জমিনে দেখা যায়, কোনো প্রতিকার না পেয়ে ফার্মের পাশের দুটি পরিবার বাড়িঘর বেওয়ারিশ অবস্থায় পরে রয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, একটি মুরগির খামার স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ও প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত হয়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় এমন স্থানে খামার স্থাপন করা যাবে না। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা না করে চলছে খামারটি।
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, খামারটির আশে পাশের অন্তত ১৫-২০ টি বাড়ীতে গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তিনজন শ্রমিক ড্রামে করে মুরগির বিষ্ঠা ভ্যানে তুলছেন। খামারটির উত্তর পাশের দুটি বাড়ী বেওয়ারিশ অবস্থায় পড়ে আছে। বাড়ীর মালিক ঘর ছেড়েছেন দুই বছর আগে। আর এসব বাড়ী থেকে তীব্র গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শ্রমিক বলেন, ‘মাছের খামারের জন্য স্থানীয় মাছের খামারের জন্য প্রতিদিন এখান থেকে ১০-১২ ড্রাম বিষ্ঠা নিয়ে যায়। প্রতি কেজি বিষ্ঠার জন্য গুনতে হয় ২০ টাকা এবং আমরা প্রতিদিন ১০ টি ড্রামে করে প্রায় ৪৫০ কেজি বিষ্ঠা নিয়ে যায়।’
ভুক্তভোগী শিউলি বেগম বলেন, ‘প্রতিদিন দুপুর থেকে পরের দিন দুপুর পর্যন্ত বিষ্ঠা জমিয়ে রাখায় গন্ধ প্রকট হয়। আমি পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ করায় আমাকে মারধরসহ বিভিন্নভাবে হেনস্থা করা হয়েছে। আমি গত ১০ জুলাই থানায় অভিযোগ করেছি। সে প্রভাবশালী হওয়ায় তার কাছে আমরা অসহায়। বিষ্ঠার দূর্গন্ধে আমি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছি, অন্যত্র চলে যাওয়ার সক্ষমতা না থাকায় অসহায়ের মতো হয়ে বসবাস করতে বাধ্য হয়েছি।’
নরসিংদী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কাশেম ভুইয়া বলেন, ‘ভুক্তভোগীর বাড়ীর পাশের খামার থেকে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পেয়েছি। তবে আমাদের হাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত না থাকায় খামারটি তুলে দিতে পারছি না। আর ভুক্তভোগীর লিখিত অভিযোগটি আদালতে প্রেরণ করার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’
আরেক ভুক্তভোগী শাহিদা আক্তার বলেন, ‘মুরগীর বিষ্ঠার দুর্গন্ধের জন্য বসবাসের অযোগ্য হওয়ায় আমি ও আমার প্রতিবেশী হোসেন আলী খান বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করতে বাধ্য হয়েছি। স্থানীয়ভাবে একাধিক সালিশ হলেও সে এসব সালিশের রায়কে তোয়াক্কা না করে গায়ের জোরে একের পর এক খামার গড়ে তুলছেন সেলিম। প্রথমে একটি ছিল। পরে, তিনটি শেড স্থাপন করে খামারে ৮ হাজারের বেশি মুরগী রয়েছে যেখান থেকে ডিম ও বিষ্ঠা উৎপাদন করে, আমাদেরকে ক্ষতির সম্মুখীন করছে।’
গত ১১ মে শিবপুর উপজেলার পাড়াতলা শামিম পোল্ট্রি ফার্মের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন স্থানীয় আশরাফুল ইসলাম ও তার প্রতিবেশিরা। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর খামারটি সরিয়ে নিতে বললেও তারা সরিয়ে নেননি।
ভুক্তভোগী আশরাফুলের অভিযোগ, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের লিয়াজুর জন্য শামিম। খামারটি সড়িয়ে নিচ্ছেন না।
তবে, এ বিষয়ে শামীমকে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
এ দুটি খামারের ন্যায় আরও ১৮ টি খামারের বিরুদ্ধ অভিযোগ জমা হয়েছে নরসিংদী জেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরে।
অভিযুক্ত আরিয়ান পোল্টি ফার্মের মালিক সালাহ উদ্দিন ওরফে সেলিম বলেন, ‘ব্যবসা করতে যাদের অনুমোদন দরকার হয়, তাদের অনুমোদন নিয়ে শুরু নিয়েছি। দু-চার জনের সমস্যার জন্য আমি ব্যবসা বন্ধ রাখতে পারবো না। আমি দীর্ঘদিন ধরে পরিচালনা করে আসছি, আমার কাগজপত্র আছে।’