সময় খবর ডেস্ক:
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রমের ফলে দেশে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মোবাইলসহ নানা ধরণের ডিজিটাল প্রোডাক্ট ও কম্পিউটার অ্যাকসেসরিজের চাহিদা। করোনা মহামারির সময় প্রযুক্তিপণ্যের প্রয়োজনীয়তা আরো বেশি করে অনুভূত হয়েছে। বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে ও যথাযথ নজরদারির অভাবে আইটি মার্কেটগুলো এখন নকল ও রিফাব্রিশড পণ্যের ডাম্পিং গ্রাউন্ডে পরিণত হয়েছে। এতে একদিকে যেমন প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতা অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। সেই সাথে দেশে গড়ে ওঠা ল্যাপটপ ও কম্পিউটার অ্যাকসেসরিজ পণ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বৈশ্বিক মন্দা, করোনা, সরবরাহ ব্যবস্থা বাঁধাগ্রস্থ হওয়া ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ল্যাপটপসহ অন্যান্য হার্ডওয়্যারের কাঁচামালের মূল্য ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফলে বৈধভাবে আমদানি করা এবং দেশে প্রস্তুত করা কম্পিউটার পণ্যের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। এর সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী।
দেশে পুরনো ল্যাপটপ, কম্পিউটার ও অ্যাকসেসরিজ আমদানি নিষিদ্ধ হলেও অবৈধ পথে নকল, নিম্নমানের ও ব্যবহৃত পণ্য এনে বাজারে নতুন বলে বিক্রি হচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় আইটি মার্কেট সয়লাব এসকল পণ্য দিয়ে। ক্রেতারা কম মূল্য দেখে ও যথাযথভাবে যাচাই বাছাই না করেই নকল ও নিম্নমানের পণ্য ক্রয় করছেন। অসাধু দোকানদারদের প্ররোচনায় কেনা পণ্য অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট হওয়াসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এসকল পণ্যে কোনো ধরণের অফিসিয়াল ওয়ারেন্টি না থাকায় বিক্রয়োত্তর সেবা থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছেন।
নকল ও পুরনো ল্যাপটপ
রাজধানীর বড় বড় আইটি মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে দোকানে দোকানে প্রদর্শিত হচ্ছে পুরনো ল্যাপটপ। দাম কম হওয়ায় ক্রেতাদের মধ্যে এসব ল্যাপটপ নিয়ে রয়েছে আগ্রহ। এসব ল্যাপটপে কোনো অফিসিয়াল ওয়ারেন্টি নেই। ক্ষেত্র বিশেষে কোনো অফিসিয়াল বক্সও দেয়া হয় না। আমদানি নিষিদ্ধ ও নিম্নমানের এসব ল্যাপটপ কিভাবে দেশে আসছে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করলে দোকানদাররা কোনো জবাব দিতে চান না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু বিক্রেতা বলেছেন কিছু কালোবাজারি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দুবাই ও চীন হয়ে লাগেজে করে এসব পণ্য দেশে আসছে। এসকল ল্যাপটপ অনেক সময় নতুন বলে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা যাচ্ছে, যাতে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহক। নামী দামী ব্র্যান্ডের রিফাব্রিশড পণ্য নতুন বলে কেনা গ্রাহকও ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে।
নকল ও পুরনো অ্যাকসেসরিজ
ল্যাপটপের সাথে নকল র্যাম, এসএসডি, মাদারবোর্ড এমনকি নকল প্রসেসরও বিক্রি চলছে দেদারসে। বাজারে এমন কিছু ব্র্যান্ডের র্যাম ও এসএসডি চোখে পড়েছে যাতে কোনো বারকোড নেই এবং আসল কোম্পানির ওয়েবসাইটেও এসকল মডেলের কোনো অস্তিত্ব নেই। রিফাব্রিশড মাদারবোর্ডও মিলছে হাতের নাগালেই। বাইরে থেকে ট্রে প্রসেসরসহ ব্যবহৃত প্রসেসর কিনে দেশে প্যাকেজিং করে বিক্রি করছে আরেকটি চক্র। এগুলো ক্রয় করে অল্প সময়েই কম্পিউটার নষ্ট হওয়াসহ নানা সমস্যা নিয়ে সার্ভিস পয়েন্টে ছুটে আসছেন গ্রাহক।
আসল পণ্য চেনার উপায়
তৈরিকৃত পণ্যের প্যাকেজিং/ আমদানিকারকের স্টিকার ভেরিফাই। পণ্যের গায়ে থাকা বারকোড স্ক্যান করা। অফিসিয়াল ওয়ারেন্টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া। ওয়েবাসাইটে পণ্যটির বিবরণ পড়ে নিশ্চিত হওয়া।
দেশীয় শিল্পে সংকট
দেশে বর্তমানে একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে ল্যাপটপ ও কম্পিউটার অ্যাকসেসরিজ উত্পাদন করছে ওয়ালটন ডিজি-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। দেশে উন্নতমানের ল্যাপটপসহ নানা কম্পিউটার অ্যাকসেসরিজ তৈরিতে শতভাগ সক্ষম প্রতিষ্ঠানটির অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমরা সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে বৈধপথে কাঁচামাল আমদানি করে ল্যাপটপসহ সব ধরণের পণ্য উৎপাদন করে থাকি। আমাদের পণ্য শতভাগ অথেন্টিক ও বিশ্ববাজারে সকল নিয়ম মেনে রপ্তানিও হচ্ছে। বর্তমানে বাজার আমদানি নিষিদ্ধ ব্যবহৃত ল্যাপটপসহ নানা কম্পিউটার পণ্য দিয়ে সয়লাব। বৈশ্বিক সংকট ও ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের পণ্যের মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন বলে বিক্রি হওয়া নকল ও নিম্নমানের পণ্য হাতের নাগালে পেয়ে ক্রেতাগণ বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হচ্ছেন। সেই সাথে অথেন্টিক পণ্য ক্রয়ে উত্সাহ হারাচ্ছেন। ক্রেতাগণ পণ্যের বারকোড ও মডেল নাম্বার তৈরিকৃত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ভেরিভাই না করেই পণ্য কেনায় প্রতারিত ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর ফলে বিপুল বিনিয়োগ করে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে রয়েছে।’ তিনি এই ব্যাপারে ক্রেতাদের সচেতন হবার অনুরোধ করেন এবং এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের তদারকি বৃদ্ধির আহবান জানান।
আইটি খাতের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় অবৈধ পথে আনা এসব আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য সংশ্লিষ্ট মহলের নজরদারির অভাবে কৌশলে দেশে ঢুকছে এবং বাজারের সিংহভাগ দখল করে আছে। জরুরি ভিত্তিতে বিক্রেতা ও ক্রেতাদের মধ্যে ব্যাপক আকারে সচেতনতা ও অবৈধ পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো উচিৎ বলে মনে করেন তারা। কারণ দেশের বাজারে এসব পণ্যের অবাধ প্রবেশে ক্রেতাগণ মানসম্মত ও অথেন্টিক প্রোডাক্ট ব্যবহার করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এবং সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
বিসিএস সভাপতি প্রকৌশলী সুব্রত সরকার বলেন, ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর ও ডলারের দাম বাড়ার ফলে ল্যাপটপের দাম বেড়ে গিয়েছে যার কারণে বিভিন্ন পথে দেশে আসা অননুমোদিত ও রিফারবিশড ল্যাপটপের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। এক্ষেত্রে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। ল্যাপটপ এখন শিক্ষার্থীদের মৌলিক চাহিদার অংশ। আর দেশীয় প্রযুক্তি উৎপাদন কারখানাকে উত্সাহিত করতে পরিকল্পনামাফিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটি পারসোনাল কম্পিউটার বা ল্যাপটপ তৈরি করতে প্রায় কয়েক হাজার ছোট ছোট যন্ত্রাংশের প্রয়োজন হয়। যদি ল্যাপটপ কম্পিউটার আমরা এ দেশে উৎপাদন করতে যাই, সে ক্ষেত্রে প্রতিটি যন্ত্রাংশ এখানে উৎপাদন করতে হবে। আবার রোবট-নির্ভর কারখানা বসিয়ে উৎপাদন করতে গেলে যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন হবে, তা রপ্তানি করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টিতেও আমাদের প্রচেষ্টা চলমান রাখতে হবে।